✍️ ভূমিকা
বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় — ব্যক্তিগত বিরোধ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নিরপরাধ মানুষ অযথা হয়রানির শিকার হন।
কিন্তু আতঙ্কিত না হয়ে যদি সঠিক আইনি ও কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে মিথ্যা মামলার প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।
⚖️ আত্মরক্ষার উপায়
১. দ্রুত একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিন
মিথ্যা মামলার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা।
তিনি মামলার ধরন, অভিযোগের প্রকৃতি, জামিনযোগ্যতা ও সম্ভাব্য আইনি প্রতিকার সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন।
২. মামলা ও জামিন সংক্রান্ত তথ্য জানুন
- মামলা থানায় রুজু হলে এজাহারের (FIR) অনুলিপি সংগ্রহ করুন।
- যদি সরাসরি আদালতে মামলা হয়ে থাকে, তাহলে আরজির কপি সংগ্রহ করতে হবে।
- অভিযোগ যদি জামিনযোগ্য হয়, তাহলে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে পারেন।
- অভিযোগ গুরুতর হলে বা জামিন অযোগ্য হলে উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করতে হবে।
৩. সব ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করুন
মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডনের জন্য যত সম্ভব প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করুন—
- চুক্তি, ছবি, ভিডিও, এসএমএস, কল রেকর্ড, ব্যাংক লেনদেনের কাগজপত্র
- অভিযোগকারীর সঙ্গে পূর্ববর্তী যোগাযোগের রেকর্ড
- ঘটনার সময় ও স্থানে আপনার উপস্থিতির সাক্ষ্যপ্রমাণ
৪. পুলিশের তদন্তে সহযোগিতা করুন
তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন এবং নিজের পক্ষে সকল প্রমাণ উপস্থাপন করুন।
যদি তদন্তে আপনার পক্ষে রিপোর্ট না আসে, তাহলে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারেন।
৫. অভিযোগকারীকে আইনি নোটিশ দিন
মিথ্যা মামলা করার মাধ্যমে যদি আপনার সুনাম বা মানহানি ঘটে, তাহলে দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির মামলা করতে পারেন।
প্রয়োজনে আগে আইনি নোটিশ পাঠিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করুন।
⚖️ আইনি প্রতিকার
১. হাইকোর্টে মামলা বাতিলের আবেদন (ধারা ৫৬১এ, CrPC)
যদি মামলাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হয়, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্টে মামলা বাতিলের (Quashing) আবেদন করা যায়।
আইনজীবীর মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে অভিযোগপত্রে কোনো অপরাধের প্রমাণ নেই।
২. মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তি (দণ্ডবিধি ২১১ ধারা)
দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় বলা হয়েছে —
“কেউ যদি জেনে শুনে অন্য কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে, তাহলে তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রযোজ্য।”
এই অপরাধে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।
৩. ক্ষতিপূরণের আবেদন (CrPC ২৫০ ধারা)
যদি আদালত মনে করেন মামলাটি মিথ্যা বা ভিত্তিহীন, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী আদালত অভিযোগকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিতে পারেন।
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সাধারণত আদালতের বিবেচনায় নির্ধারিত হয়, যা মামলা অনুযায়ী কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
৪. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রতিকার
আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২-এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে —
“যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করবে, তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে।”
⚠️ বিশেষ সতর্কতা
সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন (NLASO) থেকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা নেওয়া যায়, বিশেষ করে যদি আপনি আর্থিকভাবে অসচ্ছল হন।
পালানোর চেষ্টা করবেন না — এতে পরিস্থিতি আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারে।
শান্ত ও আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নিন; আতঙ্কিত হলে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে।
📌 উপসংহার
মিথ্যা মামলা একটি ভয়ংকর সামাজিক ও মানসিক সমস্যা। তবে সঠিক আইনগত পদক্ষেপ ও প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করা সম্পূর্ণ সম্ভব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো — সতর্ক থাকা, সঠিক আইনি পরামর্শ নেওয়া এবং ন্যায়বিচারের ওপর বিশ্বাস রাখা।





